ইসলামের পাঁচটি বিশেষ রাতের মধ্যে অন্যতম হলো শবে বরাত। শাবান মাসের ১৪ তারিখ দিবাগত রাতকে ‘লাইলাতুন নিসফি মিন শাবান’ বা ‘শবে বরাত’ বলা হয়। ‘বরাত’ শব্দের অর্থ ‘মুক্তি’। এই রাতে আল্লাহ তায়ালা তাঁর বান্দাদের প্রতি রহমতের দৃষ্টিপাত করেন এবং তাদের ক্ষমা করেন।
শবে বরাত পরিচিতি
শবে বরাত, যা লাইলাতুল বারাআত নামেও পরিচিত, ইসলামের একটি গুরুত্বপূর্ণ রাত। এই রাতে আল্লাহ তায়ালা তাঁর বান্দাদের প্রতি রহমতের দৃষ্টিপাত করেন এবং তাদের ক্ষমা করেন।
ব্যুৎপত্তি
- শবে বরাত: ফার্সি শব্দ “শব” (রাত) এবং “বরাত” (মুক্তি, নির্ধারণ) থেকে এসেছে।
- লাইলাতুল বারাআত: আরবি ভাষায় “বারাআত” (মুক্তি, নিরাপত্তা) থেকে এসেছে।
তারিখ
- হিজরী শাবান মাসের ১৪ ও ১৫ তারিখের মধ্যবর্তী রাত।
- ২০২৪ সালে, শবে বরাত ২৫ ফেব্রুয়ারি, রবিবার রাতে পালিত হবে।
গুরুত্ব
- ক্ষমা ও রহমতের রাত: আল্লাহ তায়ালা এই রাতে তাঁর বান্দাদের ক্ষমা করেন এবং রহমত বর্ষান।
- ভাগ্যলিপি নির্ধারণের রাত: এই রাতে পরবর্তী এক বছরের জন্য মানুষের ভাগ্যলিপি লিখিত হয় বলে বিশ্বাস করা হয়।
- ইবাদতের রাত: মুসলমানরা এই রাতে বিভিন্ন নফল ইবাদতের মাধ্যমে আল্লাহর কাছে ক্ষমা ও অনুগ্রহ প্রার্থনা করেন।
ইবাদত
- নামাজ: রাতের বিভিন্ন সময়ে নফল নামাজ পড়া।
- কুরআন তিলাওয়াত: পবিত্র কুরআন পাঠ করা।
- দোয়া ও প্রার্থনা: আল্লাহর কাছে ক্ষমা, রহমত, ও অন্যান্য বর-মনের জন্য প্রার্থনা করা।
- জিকির ও তাসবিহ: আল্লাহর নাম স্মরণ করা।
- সদকা ও খয়রাত: গরিব-দুঃখীদের সাহায্য করা।
শবে বরাতের ফজিলত
শবে বরাত রহমত ও মুক্তির এক মহিমান্বিত রাত্রি। এই রাতে মহান আল্লাহ রহমতের দরজা খুলে দেন। পাপীদের উদারচিত্তে ক্ষমা করেন। আল্লাহর সঙ্গে শিরক করা ও অন্তরে বিদ্বেষ পোষণকারী ছাড়া সবাইকে ক্ষমা করে দেন।
আলি ইবনে আবি তালিব (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘যখন অর্ধ শাবানের রাত তোমাদের সামনে আসে, তখন তোমরা নামাজ আদায় করো এবং পরের দিনে রোজা রাখো। আল্লাহ তাআলা এ রাতে সূর্যাস্তের পর প্রথম আসমানে অবতরণ করেন। এরপর তিনি এই বলে ডাকতে থাকেন—তোমাদের মধ্যে আছে কি কোনো ক্ষমাপ্রার্থনাকারী? আমি তাকে ক্ষমা করে দেব। তোমাদের মধ্যে আছে কি কোনো রিজিক অন্বেষণকারী? আমি তাকে রিজিক দান করব। তোমাদের মধ্যে আছে কি কোনো বিপদগ্রস্ত? আমি তার বিপদ দূর করে দেব। ফজর উদয় হওয়া পর্যন্ত এভাবেই চলতে থাকে।’ (সুনানে ইবনে মাজাহ: ১৩৮৮)
অন্য হাদিসে এসেছে, আতা ইবনে ইয়াসার (রহ.) থেকে বর্ণিত, শাবানের ১৫তম রাতে মৃতদের তালিকা (মৃত্যুর দায়িত্বে নিয়োজিত ফেরেশতার কাছে) দেওয়া হয়। এমনকি কোনো লোক সফরে বের হয়, অথচ তাকে জীবিতদের তালিকা থেকে মৃতদের তালিকায় স্থানান্তর করা হয়েছে। কেউ বিয়ে করে অথচ তাকে জীবিতদের তালিকা থেকে মৃতদের তালিকায় স্থানান্তর করা হয়েছে। (মুসান্নাফে আবদুর রাজ্জাক: ৭৯২৫)
শবে বরাতের আরো একটি তাৎপর্য হলো, এই রাতে সৃষ্টিজগতের ভাগ্য বণ্টন করা হয়। মানুষের ভাগ্য নির্ধারিত, যা পৃথিবী সৃষ্টির ৫০ হাজার বছর আগেই নির্ধারণ করা হয়েছে। তবে এ রাতে এক বছরেরটি প্রকাশ করা হয়। আয়েশা (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘তুমি কি জানো, অর্ধ শাবানের রাতের কার্যক্রম কী?’ আয়েশা (রা.) বললেন, ‘না, হে আল্লাহর রাসুল।’ নবী (সা.) বললেন, ‘এ বছর যতজন সন্তান জন্মগ্রহণ করবে এবং মারা যাবে, সেসব লিপিবদ্ধ করা হয়। এ রাতেই মানুষের আমল পৌঁছানো হয় এবং এ রাতেই তাদের রিজিক অবতীর্ণ হয়।’ (মিশকাত: ১৩০৫)
শবে বরাতের আমল
নামাজ
শবে বরাতের রাতে তাহাজ্জুদ, ইশতিকা, চাশতের নামাজ পড়া যে কোনো ব্যক্তির জন্য সওয়াব রয়েছে। তবে হাদিস থেকে নির্দিষ্ট কোনো নামাজের নির্দেশনা পাওয়া যায় না। ইবাদতের মধ্যে শ্রেষ্ঠ অংশ হলো নামাজ। সুতরাং নফল ইবাদতের মধ্যে সবথেকে ভালো হলো নফল নামাজ। শবে বরাতের রাতে বেশী বেশী নফল নামাজ আদায় করা উচিৎ। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, যখন শাবানের মধ্য দিবস আসবে, তখন তোমরা রাতে নফল ইবাদত করবে ও দিনে রোজা পালন করবে। (ইবনে মাজাহ)
রোজা
শবে বরাতের আগের দিন রোজা রাখার ফজিলত রয়েছে। এছাড়াও, শবে বরাতের রাত জেগে ইবাদত করার পরে পরবর্তী দিনে রোজা রাখাও উত্তম আমল।
তাসবিহ, তাহলিল, কোরআন তিলাওয়াত
শবে বরাতের রাতে তাসবিহ, তাহলিল ও কোরআন তিলাওয়াত করারও বিশেষ ফজিলত রয়েছে। এই আমলগুলো করে আল্লাহর স্মরণে মগ্ন হওয়া এবং তার রহমত লাভের চেষ্টা করা উচিত।
দান-সদকা
শবে বরাতের রাতে দান-সদকা করারও বিশেষ ফজিলত রয়েছে। এই রাতে গরিব-দুঃখীদের সাহায্য করা, আত্মীয়-স্বজনকে উপহার দেওয়া ইত্যাদি আমলের মাধ্যমে আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের চেষ্টা করা উচিত।
পিতামাতা ও মৃতদের জন্য দোয়া
শবে বরাতের রাতে পিতামাতা ও অন্যান্য মৃতদের জন্য দোয়া করার বিশেষ ফজিলত রয়েছে। এই রাতে তাদের জন্য ক্ষমা ও মাগফিরাত চাওয়া উচিত।
শবে বরাত নিয়ে আরো কি কি আমল করা যাবে
কবর জিয়ারত: শবে বরাতের রাতে কবর জিয়ারত করে মৃতদের জন্য দোয়া করা যায়। তবে, কবরস্থানে কোনো ধরনের বিদআতমূলক আমল যেমন, কবরের চারপাশে ঘুরা, কবরে মাথা রেখে দোয়া করা, উচ্চস্বরে দোয়া করা ইত্যাদি থেকে বিরত থাকতে হবে।
কুরআন খতম: শবে বরাতের রাতে সম্পূর্ণ কুরআন খতম করার ফজিলত রয়েছে। তবে, নিজের সামর্থ্য অনুযায়ী কুরআনের কিছু অংশ পড়াও উত্তম আমল।
জিকির ও মুনাজাত: শবে বরাতের রাতে আল্লাহর স্মরণে জিকির ও মুনাজাত করা উচিত। এটি আল্লাহর নৈকট্য লাভের সহজ পথ।
ইসলামী জ্ঞান অর্জন: শবে বরাতের রাতে ইসলামী জ্ঞান অর্জন করাও একটি উত্তম আমল। এ সময় কোনো ইসলামী ওয়াজ শোনা, কিংবা ইসলামী বই পড়া যেতে পারে।
চাইলে এই আমলগুলোও করা যেতে পারে-
- নফল নামাজের কেরাত এবং সেজদা হবে দীর্ঘ করা।
- কোরআনুল কারিম তেলাওয়াত করা।
- রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের ওপর দরূদ পাঠ করা।
- গুনাহের কথা স্মরণ করে ইস্তেগফার তথা ক্ষমা প্রার্থনা করা।
- নিজের জীবনের বড় বড় গুনাহের কথা স্মরণ করে তওবাহ করা।
- আল্লাহর রহমত ও কল্যাণ কামনা করা।
- রাতের কিছু সময় ঘুমানো।
- শেষ রাতে সেহরি খাওয়া।
- পরের দিন রোজা রাখা।
উপসংহার
শবে বরাত একটি রহমত ও মাগফিরাতের রাত। এই রাতে আল্লাহ তায়ালা তার বান্দাদের প্রতি অশেষ মেহেরবানি বর্ষণ করেন। এই রাতে আমরা বিশেষ আমলের মাধ্যমে আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের চেষ্টা করতে পারি। তবে, সবসময় সঠিক ইসলামী পদ্ধতি অনুসরণ করতে হবে এবং বিদআত থেকে দূরে থাকতে হবে।
ভ্রান্ত ধারণা
- শবে বরাতে বিশেষ কোনো নামাজ বা ইবাদতের নির্দিষ্ট নিয়ম নেই।
- কবর জিয়ারত, মিলাদ মাহফিল, ও বিশেষ খাবার বানানোর ব্যাপারে কোনো সহীহ হাদিস নেই।
গুরুত্বপূর্ণ দিক
- শবে বরাত কেবল একটি রাতের ইবাদতে সীমাবদ্ধ নয়, বরং এটি একটি আধ্যাত্মিক পরিবর্তনের রাত।
- এই রাতে ক্ষমা লাভের জন্য আন্তরিক অনুশোচনা ও তওবা করা জরুরি।
- পরবর্তী বছরের জন্য ভালো ভাগ্যলিপি লিখিত হওয়ার জন্য নেক আমলের প্রতি মনোযোগ দেওয়া উচিত।